রোম এক মায়াবী স্বপ্ন রাজ্য
ভূমধ্যসাগরে গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা। তাঁর দিকে এগিয়ে চলছে আমার প্লেন। টলটলে নিঃসীম নীল জলে কারো ছায়া নেই। চারদিকে স্থলভূমি দিয়ে ঘেরা, একপাশে ইউরোপ আরেক পাশে মধ্যপ্রাচ্য। এত কম জায়গার মধ্যে এত বড় বিশ্ব বাজার পৃথিবীতে নেই। জলপ্রবাহ না থাকলে এই বাজার দখলের উৎসাহে ভূমধ্য সাগরে জল এত দিনে লাল হয়ে যাওয়ার কথা। এই সাগরের গাঁ ঘেঁষেই খ্রিস্ট পূর্বাব্দর ও বেশ কয়েক বছর আগে গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নগরকেন্দ্রিক রোমান সভ্যতা। আজ ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ মার্চ, রোম এর বিমানবন্দর আর কয়েক মিনিট। ভূমধ্যসাগর পেরানো মাত্রই বিমান তড়িঘড়ি ঢুকে পরল রানওয়ের মধ্যে। ফিউমিন্সিনো এয়ারপোর্ট বেশ বড় ঝাঁ চকচকে। প্যারিস বা ফ্রাঙ্কফুর্ট এর থেকে কোন অংশে কম যায়না। আমি গুটিগুটি পায়ে আরাইভাল এর দিকে চললাম, সাথে আমার বন্ধু জুবিন। আরেক বন্ধু সুদূর ফ্রান্সের মার্সেই শহর থেকে আসছে । তাঁর প্লেন আসার বেশ কিছুক্ষণ দেরী আছে। আমরা দুজনে ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে একটা রেস্তুরান্টের কাছে গিয়ে বসলাম। সকালের প্রাতরাশ সারলাম। আমাদের টেবিলের ঠিক উল্টো দিকে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ। তার মুখের সামনে খোলা রয়েছে একটি পেপার। চোখের অ্যাপারচার ছোট করে পড়ার চেষ্টা করলাম। খবরের কাগজটির নাম কোরিয়ের দেল্লা সেরা (Corriere della Sera)। এয়ারপোর্টের ফ্রি ওয়াই-ফাই তে সার্চ মারলাম। 'কোরিয়ের দেল্লা সেরা' ইতালির অন্যতম সেরা জনপ্রিয় খবরের কাগজ। আচম্বিতে একটা নাম মনে পরে গেল 'পোপোলো দি ইতালিয়া'। পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রসারণের জন্য যে প্রিন্টেড মিডিয়াকে সর্বপ্রথম কাজে লাগানো হয়, তাঁর নাম 'পোপোলো দি ইতালিয়া'। বেনিতো মুসোলিনি। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্দয়, নারকীয় রাষ্ট্রনায়ক যার হাত ধরে 'পোপোলো দি ইতালিয়া'র জন্ম। অথচ এই মানুষটি ক্ষমতায় আসার পর সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ শুরু করেন। কারণ নাগরিক জীবনে খবরের কাগজের ভূমিকা তাঁর চেয়ে বেশি কেউ ভালো বুঝতেন না। মুসোলিনির কোন সঞ্জয় গান্ধী ছিল না, তিনি একা হস্তেই সকাল বেলা প্রত্যেকটি খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়তেন, এবং বিরোধী স্বর কে গলা টিপে হত্যা করতেন। আচমকা হোয়াটস অ্যাপে ফ্রান্সের বন্ধুর পিং, "কোথায়?"। আমি আর জুবিন তড়িঘড়ি ব্যাগ পত্তর গুটিয়ে আরাইভালের গেটে রওয়ানা দিলাম। তিন জনে এক জায়গায় জড়ো হলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমরা শহরে ঢুকলাম।
রোম। এক মায়াবী স্বপ্ন রাজ্য। এই শহরের সাথে আমায় প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন ফেদ্রিকো ফেলিনি। 'লা দোলচা ভিতা' সিনেমায় রোমের আনাচে কানাচে ঘুরেছেন সিলভিয়া। আমার রাতপরী আনিতা একবারগ। তাঁর আধো আধো উচ্চারণ, কাঁধ খোলা কালো ড্রেসে আনিতা একবারগ ঘুরে চলেছেন সাদা কালো রোম শহরে। রঙ বেরঙের এই রোম শহর কে আমার দেখতে ভালো লাগছিল না। আমি চোখে গলিয়ে নিলাম আমাজন থেকে কেনা কালো ওয়েফেয়ারার সানগ্লাস। এই বার ট্রেভি ফাউন্টেন যাবো। যেই ফোয়ারর মধ্যে দাঁড়িয়ে শূন্যে দু হাত প্রসারিত করে আনিতা একবারগ ডেকেছিল 'মারচেলো, কাম হিয়ার, হারী আপ'। অসহায় পুরুষের মতো মারচেলো চায়ের কাপ ফেলে ছুটে গিয়েছিল ঝরনার মধ্যে। আমি সেভাবেই ছুটে গিয়েছিলাম ট্রেভির কাছে। প্রচণ্ড ভিড় সেখানে। ১৭০০ সালে বহু ইতিহাসের সাক্ষ্য নিয়ে শুয়ে থাকা ট্রেভির জল ছুঁয়ে দেখলাম। আমি মারচেল হতে পারিনি, দূরে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম ফ্রেদ্রিকো ফেলিনির সেই ছেলেটির মতো। যে নিবিষ্ট-ভাবে তাকিয়ে ছিল মারচেলো আর স্বপ্ন-পরী আনিতা একবারগের দিকে। ট্রেভি আমায় মুগ্ধ করেছে যেমন, তেমন বিষাদ বিধুর করেছে টারমিনি স্টেশনের সাবওয়ে তে সেই গীটার বাদকের সেই হারমনি। এখনও যেন রোমের আনাচে কানাচে আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গন্ধ পাই। অ্যালাইড ফোরসের বোমায় ক্ষতবিক্ষত রোমে দুটো সমান্তরাল শহর যেন এখনো বয়ে চলেছে। একটি গ্লাদিয়েটরের রোমান সভ্যতা, অন্য দিকে আধুনিক রোম। আধুনিক রোম শহরের একদম ভেতরে রয়েছে এক একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপত্য ভাস্কর্য কলা। কলোসিয়ো মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখি চোখের সামনে দাঁড়িয়ে সেই কুখ্যাত রোমান কলোজিয়াম। শহরের একদম মধ্যে। ঠিক যেমন এসপ্ল্যানেডের মোড়ে তাজমহল। বড় অদ্ভুত জায়গা এই কলোজিয়াম, ২০০০ বছর বয়স নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরের আর্কিটেক্ট দেখলে নিঃসন্দেহে বোঝা যায় পৃথিবীর সব কটি বড় বড় স্টেডিয়াম কলোজিয়ামকেই অনুসরণ করেছে। ভেতরে এমন কিছু পয়েন্ট আছে যেখানে শব্দ করলে সারা কলোজিয়ামে সেই শব্দ মুখরিত হয়। ভেতরের হাওয়া চলাচল অস্বাভাবিক রকম বেশী। অপূর্ব শব্দবিন্যাসের ও বাতাস চলাচলের নিখুঁত পরিকল্পনার নিয়ে ৭২ খ্রিস্টাব্দে তৈরি এই কলোজিয়াম এখন ও দাঁড়িয়ে আছে নানা ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে, যার দেড় হাজারের বছরের পরে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম। এর পর একে এক ঘুরলুম পান্থেওন, পালেটাইন হিল, ও আগস্টাস সিজারের দুর্গের ধ্বংসস্তূপ। অলিভ অয়েল দিয়ে মাখা পিতজার দেশে সবচেয়ে চোখে পরার মত ইটালির দরিদ্রতা। ৫ লক্ষ সাধারণ ইথিওপিয়ান নাগরিকের, হাজার হাজার অস্ট্রিয়ান, পোল্যান্ড, যুগস্লভিয়া্ন দের অভিশাপ নিয়ে ইতালি দাঁড়িয়ে আছে। ছিনতাই, পকেটমারি ইতালির এতটাই নাজেহাল অবস্থা ভেন্ডিং মেশিনে ট্রেনের টিকিট কাটতে গেলে ভাষা পছন্দের আগে ও স্বয়ংক্রিয় স্বর তিনটি ভাষায় বলে ওঠে 'বি ওয়ার ফ্রম পকেটমার'। রাতে আমার আরেক বন্ধু নিবেদিতা এসে যোগ দেয়। আমরা সকলে মিলে যাই কলোজিয়াম। রাতের কম আলোয় কলোজিয়াম মায়াবী হয়ে উঠেছে। এক পাশ ভেঙে পরে গেলেও দম্ভ ও অস্তিত্বের সাথে কলোজিয়াম তাঁর অবস্থান জানান দিচ্ছে। রাতের কলোজিয়াম গায়ে মেখে আমরা চারজন মিলে আড্ডা শুরু করি। কলোজিয়ামের ভাঙা দিকটায় এখনও এক বাংলাদেশি বন্ধু চাবির রিং, সেলফি স্টিক বেচছে। তাঁর চোখে কলোজিয়ামের রাতের সৌন্দর্য ধরা পরে না। রাতের রোম তাকে 'লা দোলচা ভিতা'র কথা মনে করায় না। হয়তো তিনি বাই সাইকেল থিফের সংসার দায়গ্রস্ত কোন পিতা। আমার বুকের মধ্যে একটা কষ্ট দানা বাঁধে। আমি কলোজিয়ামের দিকে তাকিয়ে থাকি। মুসোলিনির একটা বিখ্যাত কথা মনে পরে যায়। অস্ট্রিয়া যুদ্ধের শেল ব্লাস্টে ক্ষত বিক্ষত হবার পরে তিনি বলেছিলেন "ওই ব্লাস্ট আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত"।
Written by rourab
10th February Friday 2017
Share
Comments
বেশ ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানলাম। আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
Write A Comment