বিশ্বরাজনীতি কিস্তি ৩ : সিরিয়া ছদ্ম-যুদ্ধ
সিরিয়া সিভিল ওয়ার এমন একটি যুদ্ধ যার মধ্যে তেল রাজনীতির কোন প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই। ২০১১ সালে যখন আরব স্প্রিঙের ঢেউ সিরিয়াতে এসে পৌছয় সারা দেশের সাধারণ মানুষ সিরিয়ার একনায়ক প্রেসিডেন্ট বাসাহর আল আসাদের বিপক্ষে সংগঠিত হন। সিরিয়ান আর্মির এক অংশ আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে যারা বিক্ষুব্ধ সিরিয়ান আর্মি নামে পরিচিত। সিরিয়ান রেবেল আর্মি বা বিক্ষুব্ধ সিরিয়ান সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের সাথে যোগ দিয়ে একনায়ক আসাদকে সিংহাসনচ্যুত করতে চান। সেনাবাহিনীর আরেক অংশ আসাদের অধীনে থাকে যাদের সিরিয়ান আর্মি বলা যেতে পারে। এইরূপে বাসাহর আল আসাদের নিজের সেনাদল দুইভাবে বিভক্ত হয়।দেশের গণতন্ত্র-কামী বিপ্লবী ও জনমত কে চাপা দিতে আসাদ সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার শুরু করেন। এরপরই সিরিয়াতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে আমেরিকা নাক গলানো শুরু করে। তেল ও ভৌগলিক অবস্থানগত ভাবে তাৎপর্যহীন একটি দেশ আমেরিকার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলা যায় রাশিয়া ও আমেরিকার ঠাণ্ডা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নতুন হাতিয়ারের ব্যবসা চালানোর জন্য আমেরিকার দরকার ছিল কোন নতুন শত্রু তৎসহ এক নতুন যুদ্ধ। ভয়ের আবহ তৈরি না হলে যুদ্ধ ব্যবসা চলবেই বা কি করে। এছাড়া এডওয়ার্ড স্নো ডেন নামে একজন আমেরিকান গুপ্তচর জানান আমেরিকার সিরিয়াতে নাক গলানোর কটি প্রধান কারণ ছিল ইজরায়েলের বিপক্ষে থাকা আরব দেশ গুলিকে যুদ্ধে ব্যস্ত রাখা।
সিরিয়ান আর্মি ও রেবেল সিরিয়ান আর্মি ছাড়াও সিরিয়াতে দেশে রয়েছে আরও দুটি দল। একদিকে কুরদিশ লড়াকু (YPG) যারা কুরদিশ ডেমোক্র্যাটিক লেফটিস্ট পার্টির সশস্ত্র শাখা। আরেকদিকে আইসিস (ISIS)। আফগান, ইরাক আমেরিকা যুদ্ধের পর এমনিতেও জঙ্গিদের কাজের অভাব পরেছিল। আসাদের বিপক্ষে লড়ার জন্য রুটি রোজগারহীন বেকার জঙ্গিদের নতুন কাজের প্রকল্প হিসাবে অর্থ ও হাতিয়ার দিয়ে আমেরিকা তৈরি করে আইসিস। ইরাক ও সিরিয়ার বড় বড় তৈল খনি গুলিকে অনৈতিক ভাবে কব্জা করে, আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইজরায়েলের দেওয়া অর্থ হাতিয়ার এবং যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নিয়ে আইসিস এক ভয়ঙ্কর দৈত্যে পরিণত হয়। কিছুদিনের মধ্যেই আইসিস আমেরিকা ও ব্রিটেনের হাতের নাগালেই বাইরে চলে যায়। পরবর্তী কালে আইসিস এর অর্থ এবং অস্ত্র জোগানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় সৌদি আরব, জর্ডন, কাতার, কুয়েত এবং ইজরায়েল। এছাড়া ও ইরাক ও সিরিয়ার অধিগৃহীত তেলের খনির তেল বেচে প্রাপ্ত অর্থে আইসিস তার ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস চালু রাখে।
কুরদিস লড়াকুরা চায় স্বাধীন দেশ কুর্দিস্তান যা তুর্কী ও সিরিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল নিয়ে তৈরি। কুরদিশ লড়াকুরা লড়ছে তিনটি দলের সাথে যথাক্রমে আসাদের পক্ষে থাকা সিরিয়ান সেনাবাহিনী, আইসিস এবং তুর্কী সরকার। এই লড়াইতে তুর্কী সরকারের অংশগ্রহণের কারণ কুর্দিস্তানের মধ্যে তুর্কীর বেশ কিছু অঞ্চল রয়েছে। যেহেতু আমেরিকা আসাদ এবং তার সেনাবাহিনী কে চায় না তাই আমেরিকা YPG কে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। একই সাথে তুর্কী আমেরিকার মিত্র-দেশ হওয়ায় YPG এর বিপক্ষে তুর্কীকে লড়ার জন্যও সমস্ত অস্ত্র আমেরিকাই দিচ্ছে। তারমানে স্বাধীন কুর্দিস্তানের আদায়ের যুদ্ধে সমর্থনে থাকা YPG এবং বিপক্ষে থাকা তুর্কী উভয়কেই আমেরিকা অস্ত্র যোগাচ্ছে।
অন্যদিকে যে বিক্ষুব্ধ সিরিয়ান আর্মি আসাদকে চান না তাদের আমেরিকা হাতিয়ার দিচ্ছে কারণ আমেরিকা আসাদকে চায় না। বিক্ষুব্ধ সিরিয়ান আর্মি সেই আমেরিকার দেওয়া অস্ত্রে আইসিস এর বিরুদ্ধে ও লড়ছে সাথে সাথে আসাদের পক্ষের সিরিয়ান আর্মির সাথে ও লড়ছে। বিক্ষুব্ধ সিরিয়ান সেনাবাহিনী ও আইসিস এর এই লড়াই এর কারণ হল আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইজরায়েলর দেওয়া হাতিয়ার ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ পেয়ে বহু সেনা বিক্ষুব্ধ সিরিয়ান সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে গিয়ে আইসিস এ যোগদান করে এবং বিক্ষুব্ধ সিরিয়ান সেনাবাহিনীর সমস্ত উন্নত অস্ত্র আইসিসের হাতে তুলে দেয়। সৌদি আরব কে আমেরিকা টাকা দিচ্ছে। সেই টাকায় সৌদি জর্ডন মারফত আইসিস কে অস্ত্র দিচ্ছে। সেই অস্ত্রে আইসিস আবার লড়ছে YPG আর বিক্ষুব্ধ সিরিয়ান আর্মির সাথে, যাদের কে হাতিয়ার ও আমেরিকা দিচ্ছে।
ইরান ও রাশিয়া সাহায্য করছে আসাদ এবং তার সেনাবাহিনী কে। কিন্তু যখন থেকে তুর্কী রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান ধ্বংস করেছে তখন থেকে রাশিয়া YPG কে অস্ত্র দিচ্ছে। তারমানে রাশিয়ার দেওয়া অস্ত্র নিয়ে YPG তুর্কীর সাথে ও লড়ছে আবার আসাদ ও সিরিয়ান আর্মির সাথেও লড়ছে। আবার আসাদ ও সিরিয়ান আর্মিকে রাশিয়াই অস্ত্র দিচ্ছে। অর্থাৎ YPG কে আমেরিকা ও রাশিয়া দুই দেশই অস্ত্র দিচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে YPGকে অস্ত্র দেওয়ার ঘটনা বিরলতম। একই যুদ্ধে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালিতম দুটি দেশ আমেরিকা ও রাশিয়া একজনকেই একই সময়ের একসাথে হাতিয়ারের জোগান দিচ্ছে।
এইভাবে সিরিয়া পরিণত হয়েছে এক সুবিশাল যুদ্ধক্ষেত্রে। এই যুদ্ধের একদিকে আছে আমেরিকা, ব্রিটেন, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ইজরায়েল, জর্ডন, তুর্কী অন্য দিকে আছে রাশিয়া, আসাদ এবং ইরাক। আমেরিকা তার যুদ্ধ ব্যবসা কায়েম রাখার জন্য সিরিয়া যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়েছিল। পরবর্তী কালে সেই যুদ্ধের সুযোগ নিতে রাশিয়া নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। এইভাবে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা সুশিক্ষিত ও অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী দুটি রাষ্ট্র শক্তি আমেরিকা ও রাশিয়া সিরিয়ার লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে সারা পৃথিবীকে বানিয়েছে সুবিশাল বধ্যভূমি। যার মধ্যে কোন ধর্ম, ন্যায়, নৈতিকতা, শ্রেণী ও মানবতা নেই।
একটি চিত্র দেওয়া হল, যেখানে দেখান হয়েছে সিরিয়া সিভিল ওয়ার এ কোন গ্রুপ কাদের কিভাবে মদত দিচ্ছে।
Written by rourab
02th January Wednesday 2019

Share
Latest Articles
ঈশ্বর এবং প্রাণের সৃষ্টি
16th April Wednesday 2025
আমি অনেক পড়াশোনা জানা উচ্চ শিক্ষিত মানুষকে বলতে শুনেছি বিজ্ঞান এবং ঈশ্বর বিশ্বাসের মধ্যে কোন স্ববিরোধিতা নেই। তারা বলেন বিজ্ঞান সাধনার সাথে সাথে ঈশ্বর সাধনাও করা যায়। এমনকি আমরা অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীকে জানি তারা ঈশ্বর বিশ্বাস read more..
ড্রাগন কন্যা
19th March Wednesday 2025
হিজাব নাকি বোরখা।
ঘোমটা নাকি রাহুর গ্রাস ।
ঠিক করবে কোথায় যাবি তুই।
স্বর্গ, নরক আর বেহেস্ত।
এই হেলমেট, এই পোশাক
তোমায় নিয়ে যায় মহাকাশ।
মহাকাশ মহাকাশ মহাকাশ ||
read more..
ঈশ্বর নেই প্রমাণের ব্যর্থতা ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি?
11th August Sunday 2024
ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে বলতে গিয়ে অনেকেই 'ঈশ্বর নেই' প্রমাণ করতে বলেন। তারা মনে করেন ঈশ্বর নেই প্রমাণের ব্যর্থতা ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি। আস্তিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্বর স্বপক্ষে যে সব যুক্তি read more..
ধর্ম এবং নৈতিকতা
26th July Friday 2024
অনেকেই বলেন ধর্ম আমাদের মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা তৈরি করে দেয়। অথচ তলিয়ে ভাবলে দেখা যায় মানুষের মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা একটি অত্যন্ত আধুনিক আইডিয়া। মাত্র একশো বছর হয়েছে মানুষ ঠিক করে বুঝতে পেরেছে ক্রীতদাস প্রথা অমানবিক। এমনকি read more..
ডিম কি menstrual waste?
18th July Thursday 2024
মুরগির ডিমকে অনেকেই menstrual waste বলে থাকেন এবং যেহেতু এটি একটি waste এবং নোংরা জিনিস তাই ডিম খেতে অনেকেই না করেন।
আদপেই মুরগির ম্যামেল প্রাণীদের মত menustral হয় না। যদি সরলীকরণ করে মুরগির ডিমকে menustral waste বলতেই হয় তবে ফুল ও কিন্তু আসলে গাছের জননাঙ্গ read more..
ক্যান্সার সারানোর উপায়
10th July Wednesday 2024
ক্যান্সার এই নামটি শুনলেই আমাদের রক্তে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। ভারতবর্ষের মত দেশে বেসরকারি হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সরকারি হাসপাতালে অব্যাবস্থায় ক্যান্সার রুগীর চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ আর ক্যান্সারের read more..
সোয়ালো সোয়ালো, লিটিল সোয়ালো
23th March Saturday 2024
অস্কার ওয়াইল্ডের সাথে আমার পরিচয় হ্যাপি প্রিন্সের মাধ্যমে। ক্লাস সেভেনে পাঠ্য বইএর অংশ ছিলো হ্যাপি প্রিন্স। ইংরেজি আমি কিছু বুঝতাম না সে ভাবে। অথচ আজ ও স্কুলের ইংরেজি টিচার হ্যাপি প্রিন্স পড়াচ্ছেন তা আজ ও কানে বাজে।
‘সোয়ালো read more.. 24th December Sunday 2023 পর্তুগীজদের এই খাবারটি নাম পাস্তেই দে বাকালহাউ ( Pasteis de Bacalhau), গোদা বাংলায় শুঁটকি মাছের চপ। ঔপনিবেশিক বা জীবনধারণের স্বার্থ, পর্তুগীজরা সমুদ্রের ওপর অত্যধিক মাত্রায় নির্ভরশীল ছিল। উত্তর আটলান্টিকের সুস্বাদু কড্ ফিশ সংরক্ষণের জন্য read more..
পর্তুগীজদের শুঁটকি মাছের চপ
Write A Comment