বিশ্বরাজনীতি কিস্তি ১ : পেট্রোডলার


১৯৪৪ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষের পর্যায়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতি নিয়ে দিশেহারা আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মান, ইটালি ইত্যাদি দেশগুলি। এই বছরের জুলাই মাসে বিশ্বযুদ্ধের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ এবং দেশ পুনর্গঠন সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে আমেরিকাতে সারা পৃথিবীর ৪৪ টি অ্যালাইড দেশের ৭৩০ জন প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসলেন। এই কনফারেন্সের নাম ছিল ব্রেটন উডস কনফারেন্স যেখানে গঠিত হয়েছিল ইন্টারন্যাশানাল মানিটারি ফান্ড (IMF) এবং বিশ্বব্যাংক। শক্তিশালী দেশ গুলির মধ্যে আমেরিকার যুদ্ধ পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল সবচেয়ে কম এবং অর্থনৈতিকভাবে আমেরিকান ডলার ছিল সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য এবং সুস্থির। তাই ব্রিটেন এর সহমতে আমেরিকান ডলারকে বিশ্বব্যাংকের সমস্ত ট্রান্সাক্সান ও সমস্ত দেশের রিজার্ভ কারেন্সি রূপে আবশ্যক করা হয়। এই সিদ্ধান্ত ছিল আমেরিকার অর্থনীতির জন্য একটি যুগান্তকারী অধ্যায় যা আমেরিকা কে সারা পৃথিবীর মধ্যে শক্তিশালীতম করে তোলে। আমেরিকা জানায় তারা অনির্দিষ্টভাবে ডলার ছাপবে না, অর্থনৈতিক সমানুপাতিতে শুধুমাত্র সোনার বিনিময়েই ডলার ছাপতে হবে এবং সারা পৃথিবীর সমস্ত দেশ কে নির্দিষ্ট ৩৫ ডলার দেবে এক আউন্স সোনার বিনিময়ে। শুরু হল আমেরিকান অর্থনীতির জয় যাত্রা।


এর প্রায় দশ বছর পর কমিউনিজম কে রোখার নামে ভিয়েতনামের সাথে যুদ্ধে নামে আমেরিকা যা ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ অবধি চলে। কুড়ি বছরের এই বিশাল যুদ্ধে আমেরিকার খরচের বহর দেখে বাকি দেশগুলির সন্দেহ হয় যে আমেরিকা বোধহয় হিসেব বহির্ভূত ডলার ছাপছে। ১৯৭০ সালে ফ্রান্স তখন আমেরিকান ডলার ছাপাখানায় অডিটের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। আমেরিকা তা অগ্রাহ্য করে। স্বভাবতই সারা পৃথিবীতে তখন ডলারের দাম পরতে শুরু করে। আমেরিকার কাছে ফ্রান্স তখন নিজেদের জমানো ডলারের বদলে তাদের সোনা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবী জানায়। তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন ফ্রান্সের এই দাবী নির্লজ্জভাবে নস্যাৎ করেন এবং ব্রেটন উডস সিস্টেম কে সাসপেন্ড করেন। ফলস্বরূপ আমেরিকান ডলারের দাম সারা পৃথিবীতে শূন্যে ঠেকে।


সারা পৃথিবীর সব দেশের রিজার্ভ কারেন্সি ডলারে সঞ্চিত থাকায় সমস্ত দেশেই এর ফলে বিপদে পরেছিল। এই দেশ গুলির মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি নিউক্লিয় শক্তিধর দেশ, স্বভাবতই আমেরিকা তখন বেশ চাপে। রিজার্ভ ডলারে বিনিময়ে আমেরিকাকে কিছু একটা ফিরিয়ে দিতে হবেই । ডলারের বদলে গচ্ছিত সোনা ফিরিয়ে দেওয়াও ছিল আমেরিকার কাছে আত্মহত্যার সমান। ১৯৭১ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন তখন ছুটে যান আরবের রাজা ফয়জলের কাছে। ফয়জলের সহযোগিতায় আরব সহ বাকি ওপেক দেশ গুলি সর্বসম্মতভাবে সমস্ত আন্তর্জাতিক তেল বিক্রয় কেবলমাত্র ডলারের বিনিময়ে করতে রাজী হন। বদলের আমেরিকা সমস্ত ওপেক দেশগুলির তৈলখনির মিলিটারি সুরক্ষা দিতে রাজী হন।


তৈলখনির সুরক্ষা ছিল ওপেক দেশ গুলির জন্য একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ ততদিনে ‘সিক্স ডে’স ওয়ার’ হয়ে গেছে। ইজরায়েলের ভয়ে ওপেক দেশ গুলির থরহরি কম্পন অবস্থা। আমেরিকা আরব ও ওপেক দেশ গুলিকে স্পষ্ট বলে যে হয় তুমি ডলারের বিনিময়ে তেল বেচ, নাহলে আরও একটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাক। আরব ও ওপেক দেশগুলির আমেরিকার এই প্রস্তাব বাধ্য হয়েই গ্রহণ করেছিল এবং আমেরিকান ডলার যার দাম সেই সময়ে শূন্য ছিল তার বিনিময়ে তেল বিক্রয় শুরু করে। ফলে যে সোনা আমেরিকার বাকি দেশ গুলিকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা উঠছিল তা ধামাচাপা পরে যায় এবং জন্ম হয় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মুদ্রার, যা কেবল মুদ্রা নয়, যা হল সারা পৃথিবীর শাসনের লাগাম। পেট্রোডলার।


আমেরিকা নিয়ে আরব দেশ গুলির স্বপ্ন অচিরেই ভাঙ্গে যখন ১৯৭৩ আরব ও ইজরায়েলের যুদ্ধে আমেরিকা ইজরায়েলের পক্ষ নেয়। এর পরের মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস যুদ্ধ বিধ্বস্ত। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের প্রত্যেকটি ঘটনায় আমেরিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে নাক গলিয়েছে। ইজরায়েলের জুজু দেখিয়ে আরব দেশ গুলিকে তৈল্যখনিতে মিলিটারি সুরক্ষা দেওয়ার নামে তাদের ডলারের বিনিময়ে তেল বেচতে বাধ্য করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজবংশগুলিকে দাসানুদাস বানিয়ে গনতন্ত্রহীন রেখে তাদের হাতে ইসলামকে ব্যবহার করার সব দায় তুলে দিয়েছে। এই আমেরিকার মত রাষ্ট্রগুলি সৌদি আরবে ও কুয়েতে, বাহরাইন, ওমান ও আমীরাতে গণতন্ত্র চায় না, গণতন্ত্র চায় ইরান ও সিরিয়াতে। কারন ওখানে শাসকগোষ্ঠী তাদের দাস নয়। আফগানিস্তানে জেহাদী পয়দা করে তালিবান বানিয়ে পুরো অঞ্চলটিকে ধ্বংস করে দিয়ে তারা এখন কারজাইকে বসিয়ে রাখে পাইপ লাইন তদারকে।


এই সন্ত্রাসীরা অস্ত্র বানায় না, কারন সেই প্রকৌশল জ্ঞান তাদের নেই। তারা অস্ত্র পায় কোথা থেকে? নকল বোমা বানানোর কথা বলে এক বাংলাদেশীকে ছাত্রকে জেলে দেয় আমেরিকা অথচ কানাডা , অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সে দাগী আসামীদের অস্ত্র নিয়ে হত্যার সুযোগ দিতে তাদের নামে মামলা থাকার পরেও প্যারোলে বা নানাভাবে এরা মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়।


২০০০ সালে ইরাকের সাদ্দাম হুসেন আমেরিকার এই নোংরা রাজিনীতির বিপক্ষে গর্জে ওঠেন এবং ডলার বর্জন করে ইউরোর বিনিময়ে তেল বিক্রি শুরু করে। ২০০৩ সালে আমেরিকা ও ব্রিটেন ইরাকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্রিটেন ও আমেরিকা দাবী করে ইরাকের হাতে বায়ো ওয়েপেন আছে যা সারা পৃথিবীর সুরক্ষা প্রশ্নে একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর অস্ত্র। একনায়ক সাদ্দাম হুসেন কে সরিয়ে গণতন্ত্র দেওয়ার নামে এবং বায়ো ওয়েপেন অজুহাতে সারা পৃথিবীর সমস্ত দেশের সুরক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়ে আমেরিকা ও ব্রিটেন ২০০৬ সালে সাদ্দাম হুসেন কে হত্যা করে। এর ঠিক কয়েক বছর পর লিবিয়ার মুহাম্মাদ গদ্দাফি ডলার বর্জন করে সোনার বিনিমিয়ে তেল বিক্রি শুরু করে। ঠিক ইরাকের কায়দায় ২০ শে অক্টোবর ২০১১ সালে লিবিয়া আধিগ্রহন করে মুহাম্মাদ গদ্দাফিকে হত্যা করা হয়।


আমরা ভুলে যাই ইন্দোনেশিয়াতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে কমিউনিজম ঠেকানোর নামে সুকর্ণ কিংবা ব্রাদারহুড ইলেকশন জিতবার পরেও তাদের জোর করে সামরিক বাহিনী দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা শক্তি, মুসলিম শক্তি না।আমরা ভুলে যাই গোটা দুনিয়াটাকে একটা বিরাট যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়েছে যারা তারা মুসলিম না। দুনিয়ার বড় বড় সামরিক ঘাঁটিগুলি মুসলিমদের নয়। বছরের পর বছর আরব দেশগুলি ও এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলিকে ধামাধরা শাসক দিয়ে লুটপাট করিয়ে দারিদ্র ও বঞ্চনার বিস্তার ঘটিয়েছে যারা , তারা মুসলিম না


Written by rourab

22th October Monday 2018



   Share  

Write A Comment