বিশ্বরাজনীতি কিস্তি ২ : ভিয়েতনাম যুদ্ধ


ভিয়েতনাম যুদ্ধ পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ যা লড়া হয়েছিল একটি মতবাদের আধিপত্য রুখতে। ১৯৪১ সাল অবধি পৃথিবীতে ভিয়েতনাম নামের কোন দেশই ছিল না। ১৮৬০ থেকে ১৯৪১ সাল এই অঞ্চল ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ যার নাম ছিল ফ্রেঞ্চ-ইন্দো-চায়না। এই দেশ ছিল তিনটি দেশের সমষ্টি, লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ফ্রান্সের থেকে ভিয়েতনাম দখল করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হারার পর উত্তর ভিয়েতনামের জাপানের সৈনিকরা আত্মসমর্পণ করে চীনের কাছে এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের জাপান সৈনিকরা আত্মসমর্পণ করে ব্রিটেনের কাছে। ব্রিটেন দক্ষিণ ভিয়েতনাম পুনরায় ফ্রান্সকে দিয়ে দেয় কিন্তু চীন উত্তর ভিয়েতনাম ফিরিয়ে দেয় সেখানকার স্থানীয় মানুষদের কাছে, যাদের নেতা ছিলেন কমিউনিস্ট হো চি মিন। ফ্রান্স হারানো উত্তর ভিয়েতনাম পুনরায় কব্জা করার চেষ্টা শুরু করে। শুরু হয় যুদ্ধ যা ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি চলে। এই যুদ্ধে হো চি মিনের নেতৃত্ব উত্তর ভিয়েতনামের স্থানীয় লোকেরা ফ্রান্সের সাথে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালায়। এই যুদ্ধে ফ্রান্স হেরে যায় এবং নিজেদের সৈনিকেদের প্রাণ বাঁচাতে আলোচনার টেবিলে যেতে রাজি হয় এবং জেনেভা যুদ্ধ সমঝোতায় পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এই অঞ্চলকে চারভাগে ভাগ করে। লাওস, কম্বোডিয়া, উত্তর ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম। এখানে মনে রাখা দরকার উপনিবেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় দেশ ভাগের রাজনীতি পশ্চিমী দেশ গুলির একটি রাজনৈতিক সুপরিকল্পনা। দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট হন ফ্রান্স, আমেরিকা ও ব্রিটেন এর ধামাধারি নেতা 'নো দিন দিয়েম'। অন্যদিকে উত্তর ভিয়েতনাম হো চি মিনের হাতেই থাকে। কিছু দিনের মধ্যেই নো দিন দিয়েমের স্বেচ্ছাচারী, একনায়ক শাসনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রচুর মানুষ একক ভিয়েতনামের স্বপ্ন দেখে। হো চি মিন ও রাশিয়ার সহযোগিতায় দক্ষিণ ভিয়েতনামে এই মানুষরা বিপ্লবী কার্যকলাপ শুরু করেন। আমেরিকা ও দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু আমেরিকার যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য দরকার ছিল একটি উপযুক্ত বাহানা। ১৯৬৪ সালে আমেরিকা নিজেদের জাহাজ দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাহায্যে আক্রমণ করায় এবং উত্তর ভিয়েতনামের ওপর দোষ চাপিয়ে যুদ্ধে নামে। ততদিনে জন এফ কেনেডি কে হত্যা করা হয়েছে এবং লিন্ডন জন্সন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। বহু ইতিহাসবিদ জন এফ কেনেডির হত্যার ষড়যন্ত্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সংযোগের কথা বলেন। ১৯৬৫ সালে আমেরিকা এই যুদ্ধে ঝাঁপায় এবং উত্তর ভিয়েতনামের জঙ্গল রাসায়ানিক অস্ত্রের মাধ্যমে ধ্বংস করে এবং লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। কিন্তু হো চি মিনের গেরিলা সৈনিকরা সারা উত্তর ভিয়েতনামে সুরঙ্গ তৈরি করে তার মধ্যে লুকিয়ে থেকে আমেরিকান সৈনিকদের মারতে থাকে। ১৯৬৮ সালে আমেরিকা ৫ লাখ সৈনিক ভিয়েতনামে পৌছয় এবং আড়াইলাখ ভিয়েতনামি গেরিলা সৈনিক রাশিয়ার সহযোগিতায় এক কঠিন লড়াই লড়তে থাকে। জল জঙ্গলে ঘেরা জমিতে যুদ্ধের কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় আমেরিকান সৈনিক নাস্তানাবুদ হতে থাকে। তৎকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে আমেরিকা দুটি কারণে চাপে পড়ে। প্রথমত হিসেব বহির্ভূত ডলার ছাপানো [১] এবং দ্বিতীয়ত ভিয়েতনাম যুদ্ধের পেন্টাগনের গোপন ফাইল আমেরিকার সাংবাদ পত্রে লিক হয়। আমেরিকার মানুষ ভিয়েতনামের 'মাই লাই’ ও 'বেন ট্রি প্রভিন্সের' নর সংহারের কথা জানতে পারে যেখানে আমেরিকা সৈনিক একের পর এক গ্রামে শিশু ও মহিলাদের জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়। সাধারণ আমেরিকানরা জানতে পারেন একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশ ভিয়েতনামে গণতন্ত্র দেওয়ার নামে মোট সাত কোটি ছেষট্টি লাখ দুশো টন বোমা ফেলে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় চার গুন বেশী। সাধারণ মানুষদের আন্দোলনের চাপে ১৯৭৩ সালে আমেরিকা বাধ্য হয় ভিয়েতনাম থেকে তাদের সৈন্য ফেরত আনতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রায় ষাট হাজার আমেরিকান সৈনিক মারা যান এবং ২০ লক্ষ ভিয়েতনামি মারা যান। এখানে মনে রাখতে হবে গণতান্ত্রিক দেশেও রাষ্ট্রনেতা ও তার নীতি এবং সেই রাষ্ট্রের মানুষ ও তাদের জনমত দুটি ভিন্ন চেতনা। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি জানার পরে আমেরিকার রাষ্ট্রনীতি ও জনমত দুটি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করত। ঠিক একই ভাবে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ইরান এদের রাষ্ট্রনীতির জন্য এদেশের মানুষদের ঘৃণা করা শ্রেয় নয়।


এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন কেন আমেরিকা এই বিধ্বংসী যুদ্ধ ভিয়েতনাম নামের একটি দেশের সাথে লড়তে গেছিল যেদেশের কোন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য ছিল না। আমেরিকা মনে করত ভিয়েতনাম হল একটি ডমিনো এবং ভিয়েতনাম কমিউনিজমে আক্রান্ত হলে একে একে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় কমিউনিজম ছড়িয়ে পড়বে। হো চি মিন এবং তৎসহ চীন ও রাশিয়ার কমিউনিজমকে আটকাতে আমেরিকা তার সর্ব শক্তি দিয়ে যুদ্ধ লড়েছিল। যুদ্ধ শুরুর সময় আমেরিকার মানুষ জেনেছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকান সৈনিক ভিয়েতনামে লড়ে যাচ্ছে, সত্য প্রকাশ হওয়ার পর সাধারণ মানুষরাই এই যুদ্ধ বন্ধের জন্য রাষ্ট্রকে চাপ দেয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ব্যায়ভার বহন করার জন্য আমেরিকার উন্নয়ন থমকে গেছে। ছলে বলে কৌশলে আমেরিকা পেট্রোডলার প্রতিষ্ঠা করেছে। এই মুহূর্তে বিশ্বে পাঁচ দিনে অস্ত্র কেনাতে যা টাকা খরচ হয় তা হু (WHO) এর ৭০ বছরের গুটি বসন্ত উচ্ছেদ কর্মসূচির সমান। কাশ্মীরের প্রত্যেক দশ জন মানুষ পিছু একজন সৈন্য। কাশ্মীর পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিক বসতিপূর্ণ এলাকা। এই বিশ্বে প্রতি এক লক্ষ মানুষ পিছু ৫৫৬ জন সৈন্য আছে। অথচ পৃথিবীতে প্রতি এক লক্ষ মানুষের জন্য মাত্র ৮৫ জন ডাক্তার আছেন। প্রতিটি সেনার জন্য বছরে গড়ে ৭০ হাজার ডলার খরচ হয় অথচ এই বিশ্বে স্কুলে যাওয়া প্রতিটি শিশুর জন্য বছরে আমরা মাত্র ৩৮০ ডলার খরচ করি। এই বিশ্বের তিন সপ্তাহের সামরিক খরচের টাকা দিয়ে সারা বিশ্বের এক বছরের খাবার জলের জোগান সম্ভব। এই দুনিয়ায় এক বছরে রোগ ও অনাহারে মারা যায় এক কোটি শিশু। অথচ প্রতি মিনিটে আমরা অস্ত্রের জন্য খরচ করি ৬৫ লক্ষ ডলার। অস্ত্র ব্যাবসায়িদের অঙ্গুলিহেলনে রাষ্ট্রনেতারা দেশের নাগরিক দের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয়জল ইত্যাদি প্রাথমিক প্রয়োজনকে গুরুত্ব না দিয়ে কোটি কোটি টাকায় অস্ত্র কিনছে। সাধারণ মানুষকে বোঝানো হচ্ছে অস্ত্র না কিনলে প্রতিবেশ দেশ ঢুকে পড়বে। সারা দেশে গুলি বোমা মেরে দেশের মানুষকে হত্যা করবে। গুলি বোমা মেরে মানুষ কে নিমেষে হত্যা করা যায় ঠিকই কিন্তু আনাহার, বেকারত্ব, অশিক্ষা দিয়ে মানুষকে জীবনের প্রতিটি দিন তিল তিল করে বারংবার হত্যা করা যায়। যে হত্যা 'গুলি মেরে' হত্যার চেয়ে অনেক বেশী নির্মম।


Written by rourab

14th November Wednesday 2018



   Share  

Write A Comment



 



Latest Articles



ঈশ্বর এবং প্রাণের সৃষ্টি

16th April Wednesday 2025


আমি অনেক পড়াশোনা জানা উচ্চ শিক্ষিত মানুষকে বলতে শুনেছি বিজ্ঞান এবং ঈশ্বর বিশ্বাসের মধ্যে কোন স্ববিরোধিতা নেই। তারা বলেন বিজ্ঞান সাধনার সাথে সাথে ঈশ্বর সাধনাও করা যায়। এমনকি আমরা অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীকে জানি তারা ঈশ্বর বিশ্বাস read more..



ড্রাগন কন্যা

19th March Wednesday 2025


হিজাব নাকি বোরখা।

ঘোমটা নাকি রাহুর গ্রাস ।

ঠিক করবে কোথায় যাবি তুই।

স্বর্গ, নরক আর বেহেস্ত।


এই হেলমেট, এই পোশাক

তোমায় নিয়ে যায় মহাকাশ।

মহাকাশ মহাকাশ মহাকাশ ||

read more..


ঈশ্বর নেই প্রমাণের ব্যর্থতা ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি?

11th August Sunday 2024


ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে বলতে গিয়ে অনেকেই 'ঈশ্বর নেই' প্রমাণ করতে বলেন। তারা মনে করেন ঈশ্বর নেই প্রমাণের ব্যর্থতা ঈশ্বরের অস্তিত্বের স্বপক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি। আস্তিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্বর স্বপক্ষে যে সব যুক্তি read more..



ধর্ম এবং নৈতিকতা

26th July Friday 2024


অনেকেই বলেন ধর্ম আমাদের মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা তৈরি করে দেয়। অথচ তলিয়ে ভাবলে দেখা যায় মানুষের মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা একটি অত্যন্ত আধুনিক আইডিয়া। মাত্র একশো বছর হয়েছে মানুষ ঠিক করে বুঝতে পেরেছে ক্রীতদাস প্রথা অমানবিক। এমনকি read more..



ডিম কি menstrual waste?

18th July Thursday 2024


মুরগির ডিমকে অনেকেই menstrual waste বলে থাকেন এবং যেহেতু এটি একটি waste এবং নোংরা জিনিস তাই ডিম খেতে অনেকেই না করেন।

আদপেই মুরগির ম্যামেল প্রাণীদের মত menustral হয় না। যদি সরলীকরণ করে মুরগির ডিমকে menustral waste বলতেই হয় তবে ফুল ও কিন্তু আসলে গাছের জননাঙ্গ read more..



ক্যান্সার সারানোর উপায়

10th July Wednesday 2024


ক্যান্সার এই নামটি শুনলেই আমাদের রক্তে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। ভারতবর্ষের মত দেশে বেসরকারি হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সরকারি হাসপাতালে অব্যাবস্থায় ক্যান্সার রুগীর চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ আর ক্যান্সারের read more..



সোয়ালো সোয়ালো, লিটিল সোয়ালো

23th March Saturday 2024


অস্কার ওয়াইল্ডের সাথে আমার পরিচয় হ্যাপি প্রিন্সের মাধ্যমে। ক্লাস সেভেনে পাঠ্য বইএর অংশ ছিলো হ্যাপি প্রিন্স। ইংরেজি আমি কিছু বুঝতাম না সে ভাবে। অথচ আজ ও স্কুলের ইংরেজি টিচার হ্যাপি প্রিন্স পড়াচ্ছেন তা আজ ও কানে বাজে।

‘সোয়ালো read more..



পর্তুগীজদের শুঁটকি মাছের চপ

24th December Sunday 2023


পর্তুগীজদের এই খাবারটি নাম পাস্তেই দে বাকালহাউ ( Pasteis de Bacalhau), গোদা বাংলায় শুঁটকি মাছের চপ। ঔপনিবেশিক বা জীবনধারণের স্বার্থ, পর্তুগীজরা সমুদ্রের ওপর অত্যধিক মাত্রায় নির্ভরশীল ছিল। উত্তর আটলান্টিকের সুস্বাদু কড্ ফিশ সংরক্ষণের জন্য read more..



rourab

rourab paul


Elementum purus morbi
rourab paul social network