সংরক্ষণ ও কতগুলি প্রশ্ন
সরকারি চাকরির কম্পিটেটিভ পরীক্ষাগুলোতে বা কোন ইন্সটিটিউটের প্রবেশিকা পরীক্ষা গুলোতে একজন যুবক-যুবতী যখন দেখেনে তার চেয়ে কম নম্বর পেয়ে একজন এসসি বা এসটি সুযোগ পেয়ে গেছে কিন্তু সে জেনারেল ক্যান্ডিডেট হয়ে বেশি নম্বর পেয়ে ও সুযোগ পাননি, তখন রাগ হয়। তাৎক্ষনিক ইমোশন বলে এসসি বা এসটি ছেলে বা মেয়েটির জন্য জেনারেল ক্যান্ডিডেটটির সুযোগ পাওয়া হল না। আজকের জেন-যি রা মূলত দুটি জিনিস মনে করে
১) জাতিগত সংরক্ষণ অনুচিত, সংরক্ষণ যদি বা হয় তবে শুধু মাত্র অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে হওয়া উচিত।২) সংরক্ষণ থাকাই উচিত না। মেধাই যোগ্যতা বিচারের একমাত্র উপায় হওয়া উচিত।
১)জাত না অর্থনৈতিক সংরক্ষণ ?
এই আলোচনা শুরুর আগেই আমরা সংরক্ষণ শব্দটা বর্জন করে একে জাতের নিরিখে এফারমেটিভ একশন বলব। সারা পৃথিবীতে প্রতিটি দেশে বিভিন্ন ফরমে এফারমেটিভ একশন নেওয়া হয়। যেই যেই প্যারামিটারের নিরিখে একটি দেশের মানুষ দেশের রিসোর্সের ব্যাবহার করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন সেই সেই প্যারামিটারের নিরিখে সেই দেশে এফারমেটিভ একশন দেওয়া হয়। এই প্যারামিটার গুলো দেশ, কাল, পাত্র ভেদে পাল্টে যায়।
ভারতবর্ষে শিক্ষা, কর্ম সংস্থান ও অন্যান্য বিভিন্ন পরিষেবায় (দেশের রিসোর্স) সাধারণ মানুষের সমান অধিকার বঞ্চিত হয় মূলত চার ধরনের বৈষম্যর জন্য।
১।১)বাসস্থানগতঃ শহরাঞ্চলে কর্মক্ষেত্র, স্কুল-কলেজে, হাসপাতাল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সংখ্যায় অনেক বেশী হওয়ায় শহরের মানুষেরা গ্রাম ও মফঃস্বলের মানুষদের থেকে অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা উপভোগ করেন।
১।২) অর্থনৈতিক: ধনীরা গরিবদের তুলনায় সমাজের প্রায় প্রত্যেকটি বিষয়ে অধিক সুবিধা ও সুযোগ পেয়ে থাকে। অর্থের অভাবে গরীবরা শিক্ষার থেকে তাৎক্ষনিক কর্মসংস্থানে বেশী আগ্রহী হন। তারা উচ্চ শিক্ষার দরজা অবধি পৌছতেই পারেন না। মধ্যমেধার গরীব ছাত্ররা ধনী ছাত্রদের মতো প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারেন না। এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি সমান্তরাল মানিটারি সংরক্ষণের জন্ম দিয়েছে।
১।৩) লিঙ্গ বৈষম্য: যেখানে পুরুষরা মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশী সামাজিক সুবিধা পেয়ে থাকে। এই তিনটি বৈষম্য আমরা খুব সহজেই স্বীকার করি, কিন্তু
১।৪)জাতিগত বৈষম্যে: এর কথা বলতে গেলে আমরা খুব একটা সহমত হই না। আসুন আমরা প্রমাণ ও পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই। আমরা পথে ঘাটে ফেসবুকে যাদের জেনারেল বলি তাদের একটা পরিচয় খুব সযত্নে এড়িয়ে যাই। এই জেনারেল কারা? জেনারেল মানে হল হিন্দু উচ্চ বর্ণ। সরকারি হিসবে বলছে ভারতের মোট জনসংখ্যার ২৬% জেনারেল বা হিন্দু উচ্চ বর্ণ। যদিও সমাজতাত্ত্বিকদের গবেষণা বলছে জেনারেলদের সঠিক সংখ্যা ২০% এর আশপাশে। এবার দেখেনি সমাজের বিভিন্ন এলিট প্রতিষ্ঠানে এই জেনারেলদের শেয়ার কতটা। সরকারি বেসরকারি উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গুলোয় মোট ছাত্র ছাত্রীর ৬৭% হল জেনারেল এবং মোট শিক্ষকের ৬৬% জেনারেল। সুতরাং ভারতবর্ষের ১/৩ ভাগ কমিউনিটি শিক্ষাক্ষেত্রের ২/৩ অংশ দখল করে রেখেছে। সমস্যা এই নয় যে জেনারেলরা এই সিংহভাগ শিক্ষাগত রিসোর্স অবস্থান করে আছেন, সমস্যা হল তারা ক্রমাগত খুব বাজে ভাবে অভিযোগ করে যাচ্ছেন যে তারা সংরক্ষণের জন্য এই ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোয় পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। একই অভিযোগের সুর কর্মক্ষেত্রেও। অথচ ভারতবর্ষের মোট চাকরীর মাত্র ২% সরকারী চাকরী যেখানে সংরক্ষণের সুবিধে আছে। বাকি ৯৮% বেসরকারি ও অসংগঠিত কর্মক্ষেত্রে সংরক্ষণের কোন ও সুবিধে নেই।
আমরা যারা যুক্তি ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কথা বলতে ভালোবাসি, তাদের আরও কিছু জিনিস বুঝতে হবে। নীচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সমস্ত ক্যাটেগরিতেই জেনারেল বা হিন্দু উচ্চবর্ণরা বেশি পড়াশুনা (গ্র্যাজুয়েট) করেছন, এবং নিচু জাতের মানুষরা কম পড়াশোনা করছেন। এই সংখ্যাতত্ত্ব থেকে আমাদের ভাবতে বাধ্য হতে হবে যে সমাজের কোন বিশেষ কারণের জন্য হিন্দু উচ্চবর্ণদের শিক্ষিত হওয়ার প্রবণতার ওপর ধনী-গরীব(অর্থ), নারী-পুরুষ(লিঙ্গ) শহর-গ্রাম(বাসস্থান) এসবের কোন প্রভাবই পরেনি।একই রকম ভাবে বলা যায় নিচু জাতের শিক্ষিত হওয়ার হারে ওপর ও ধনী-গরীব(অর্থ), নারী-পুরুষ(লিঙ্গ) শহর-গ্রাম(বাসস্থান) এসবের কোন প্রভাবই পরেনি।সেই বিশেষ কারণটি যেহেতু সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক তাই তাকে উদেশ্যপ্রনোদিত ভাবে ব্রাত্য রাখা হল। সুতরাং এই কথা বলা যেতেই পারে সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে শিক্ষা সম্পদ আহরণে জাত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার, যদি একটি নির্দিষ্ট জাতের মানুষ ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ এবং শহর-গ্রাম নির্বিশেষে বেশী শিক্ষিত হয়ে থাকেন এবং সেই বিশেষ জাতের মানুষ যদি জনসংখ্যার নিরিখে ১/৩ ভাগ হয়েও দেশের শিক্ষা রিসোর্সের ২/৩ ভাগ অংশ জুড়ে অবস্থান করে; তবে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া বাকি মানুষদের সমান সুযোগ তৈরি করতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতেই হবে। আর এই সংরক্ষণ অবশ্যই জাতের ভিত্তিতেই হতে হবে। মানুষ গরিব থেকে ধনী হতে পারে কিন্তু কখনো দলিত থেকে ব্রাহ্মণ হতে পারে না তাই জাতই সমাজের এমন একটি দুর্লভ সার্টিফিকেট যেটা কক্ষনো মিথ্যে বলতে পারে না। যেহেতু প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানুষ জাতের ভিত্তিতেই শোষিত হয়েছে তাই জাতিগত সংরক্ষণই একমাত্র সংরক্ষণ যা কাজ করতে বাধ্য।
দেখে নেওয়া যাক সংরক্ষণ কি ভাবে পিছিয়ে পরা মানুষদের এগিয়ে নিয়ে গেছে। ৯৩-৯৪ সালে গ্রামের ৬৩% ও ৬৫% SC ও ST মানুষ গরিবি রেখার নীচে ছিলেন, যেই সংখ্যাটি ২০১১-১২ তে ৩১% ও ৪৫%। শহরাঞ্চলে এই একি সংখ্যাটি ৫১% থেকে ২১% ও ৪১% থেকে ২৪% এ নেমে এসেছে। এই উন্নতিতে সংরক্ষণের মতো এফারমেটিভ অ্যাকশানের জন্যই। অর্থাৎ ধীরে হলে ও সংরক্ষণের কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। সরকারি চাকরিতে এ গ্রেডে মাত্র ১১% ও ৫% SC, ST, অথচ সরকারী সাফাইকর্মী দের মধ্যে প্রায় ৪০% মানুষ SC-ST। এই সকল ডেটাই জাতিগত সংরক্ষণের পক্ষে যুক্তি দেয়।
কিন্তু এই কথাও নিঃসন্দেহে বলা যায় জাতিগত সংরক্ষণই সামাজিক সাম্য গড়ার একমাত্র উপায় হতে পারে না। এখন এই সংরক্ষণকে আরও ভালোভাবে ক্রিয়াশীল করতে গেলে আরও কিছু জিনিস ভাবা যেতে পারে। ১। আপার ওবিসি থেকে ক্রিমি লেয়ার বাদ দেওয়া, যেটা সরকার করেছে।
২। যদি কোন পরিবারের একটি প্রজন্ম সংরক্ষণ থেকে সুবিধে পেয়ে থাকে তবে পরের প্রজন্মে সংরক্ষণের সুবিধে শর্ত-গত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৩।এস সি, এস টি, ওবিসিদের কেউ যদি ক্রমাগত সংরক্ষণে সামাজিক ভাবে এগিয়ে আসে তাদের সংরক্ষণের আওতা থেকে বাদ দিতে হবে। সংরক্ষণের বুনিয়াদি প্রশ্নে আরও কিছু জিনিস আমাদের চিহ্নিত করেত হবে
১।সমাজে মানুষ অর্থ, জাত এবং ধর্মের নিরিখে কি কি সামাজিক সুবিধে পায়।
২। জন্মসূত্রে মানুষ কি কি বৈষম্যের শিকার হয়।
৩। গ্রামে উপযুক্ত নারী শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৪। সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
২) মেধাই যোগ্যতা বিচারের একমাত্র উপায়
পথে ঘাটে পথ চলতি মানুষের মুখে শোনা যায় মেধাই নাকি যোগ্যতা বিচারের একমাত্র উপায়। আজকের সমাজে যদি টাকা থাকে তবে সত্যি ই মেধার কোন ভূমিকাই থাকে না। সমান মধ্য মেধার একটি গরীব ছাত্র আইআইটি, এনআইটি বা সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ না পেলে দশ লাখ টাকা দিয়ে বেসরকারি কলেজে গুলোতে পড়তে পারবে না, কিন্তু ধনী পরিবারের ছেলে তা পারবে এবং একটি মধ্যমানের আইটি চাকরি সে সহজেই জুটিয়ে নিতে পারবে। আদানি আম্বানির ছেলে যখন বংশ পরম্পরায় রিলায়েন্সে বা আদানি গ্রুপের সর্বেসর্বা হবে সেই সময় তার মেধার বিচার হয় না কিন্তু হাড় হাভাতের ছেলে কম নম্বর পেয়ে চাকরি পেলেই দেশের ব্যাবস্থা ভেঙ্গে যাবে দলিতের অযোগ্যতায়। যে সামাজিক ও আর্থিক নীতি একটি আদনি বা আম্বানির জন্ম দেয়, সেই একই পরিকাঠামো দু বেলা খেতে না পাওয়া কোটি কোটি বুভুক্ষ ভারতবাসীর জন্ম ও দিয়েছে। এই বৈষম্যের দায় অবশ্যই এই দেশের নীতি নির্ধারকদের। যে মধ্যবিত্ত এই দুই ভারতের জন্মের পেছনে মেধা'র কথা বলে, তারা আসলে স্বার্থপর এবং ধান্দাবাজ। পৃথিবীতে কোনো মানুষ তার মেধার জন্য গরীব থেকে বড়োলোক হতে পারলে ও মেধা না থাকার জন্য কেউ ধনী থেকে গরীব হয়নি, আবার গরীব মানুষরা ও মেধা না থাকার ফলে গরীব থেকে যায় না সারা জীবন। অন্যদিকে অর্থ থাকলে যে মেধা'র কোনো ভূমিকাই থাকে না, এই কথা মধ্যবিত্তরা কোনো দিন বলবেই না। তুমি গরীব কারণ তোমার মেধা নেই এই অজুহাত আসলে এক নির্লজ্জ মিথ্যাচার। পৃথিবীতে কোনো মানুষ মেধাহীন ভাবে জন্মাতে পারে না।
মনে রাখবেন মেরিটের সাথে সাথেই সমাজের সকল স্তরে সমাজের সমস্ত গ্রুপের প্রতিনিধি উঠে আসাটা ও সোসিও ইকনোমিক নেসেসিটি।
পরিশেষে কিছু কথা মনে করিয়ে দেওয়া ভীষণ দরকার। এই সংরক্ষণের সুবিধে একটি সমাজকে আজীবন দেওয়া যায়না। সংরক্ষণ কোন গর্বের বিষয় নয়, এটি সমাজের একটি ভয়ঙ্কর কালো অধ্যায়ের সূচক বহন করে। যেদিন আমাদের সমাজ থেকে জাতিগত বৈষম্য সম্পূর্ণ ভাবে মুছে যাবে, যেদিন আমাদের সমাজ থেকে সমস্ত ধরনের বৈষম্য সড়ে যাবে, সেদিনই সংরক্ষণ ও তার প্রয়োজনীয়তা হারাবে।
সুত্রঃ-AISHE, NSSO অনুপ্রেরণাঃ কিষান পট্টনায়ক, যোগেন্দ্র যাদব
Written by rourab
18th September Monday 2017
![](images/2017-09-18_FB_IMG_1703059360114.jpg)
Share
Write A Comment